Breaking

Thursday, April 26, 2012

পঞ্চম শ্রেণি - সমাজ - অধ্যায় ১২ - আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

সংক্ষেপে উত্তর দাওঃ

প্রশ্নঃ (ক) বাংলায় কে এবং কীভাবে স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তরঃ বাংলার ইতিহাসে ১৩৩৮ সাল থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত সময়কালকে স্বাধীন সুলতানি শাসন আমল বলে। স্বাধীন সুলতানি আমলের প্রতিষ্ঠাকারী ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ স্বাধীন সুলতানি আমল প্রতিষ্ঠা করেন। 

যেভাবে প্রতিষ্ঠা করেনঃ দিল্লির মুসলিম সুলতানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পরাজিত করে ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ সুলতানি আমলের সূচনা করেন। ১৩৩৮ সালে তিনি সোনারগাঁওয়ের ক্ষমতা দখল করে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। তার রাজত্বকালে আফ্রিকার বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সোনারগাঁওয়ে আসেন। ১৩৩৮ সাল থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত দু‍’শ বছর স্বাধীন সুলতানি আমল অব্যাহত থাকে। প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ।
সুতরাং ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ ছিলেন স্বাধীন সুলতানি আমলের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ।

প্রশ্নঃ (খ) হোসেন শাহী আমলকে বাংলার মুসলমান শাসনের স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন?
উত্তরঃ ১৪৯৩ সালে হোসেন শাহী বাংলার শাসনকার্য শুরু করেন। সৈয়দ হোসেন সুলতান হয়ে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। 

হোসেন শাহী আমলকে বাংলার মুসলমান শাসনের স্বর্ণযুগ বলার কারণঃ বাংলায় স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে হোসেন শাহী আমল ছিল সবচেয়ে কৃতিত্বের যুগ। হোসেন শাহ ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ সুলতান। তিনি বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করেন। তিনি ছিলেন প্রজা দরদি ও বহুগুণের অধিকারী। তার আমলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অনেক উন্নতি হয়। শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন তার শাসনামলে। 

হোসেন শাহের পর আরও তিনজন সুলতান বাংলা শাসন করেন। তারা সবাই যোগ্য শাসক ছিলেন। তারাও উদারভাবে রাজ্য শাসন করেন। তারা সকলেই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এজন্য হোসেন শাহী আমলকে বাংলার মুসলমান শাসনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। 

উপরোক্ত কারণে হোসেন শাহী আমলকে বাংলার মুসলমান শাসনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ বংশের শেষ সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ।

প্রশ্নঃ (গ) বার ভূঁইয়া বলতে কী বুঝ? বাংলার বার ভূঁইয়াদের কয়েকজনের নাম লেখ।
উত্তরঃ দাউদ কররাণীকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে বাংলায় মোগল শাসনের সূচনা হয়। দিল্লির সম্রাট আকবর সম্পূর্ণ বাংলার ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এ সময় বাংলার বার ভূঁইয়াদের তত্পরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। 

বার ভূঁইয়াদের পরিচয়ঃ মোগল সম্রাট আকবর যখন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম এবং উত্তর বাংলার বেশ কিছু অঞ্চল বড় বড় জমিদারদের অধিকারে ছিল। অধিকাংশ জমিদারই আকবর বা মোঘলদের দাসত্ব মানেননি। তারা নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন। তাদের শক্তিশালী সৈন্যদল ও নৌবাহিনী ছিল। তারা বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত। এই বার বলতে বারজনের সংখ্যা বোঝায় না। সমসাময়িক ঐতিহাসিকেরা বার ভূঁইয়া ও তাদের নেতার কথা বলেছেন। অর্থাৎ তাদের নেতাসহ বার ভূঁইয়ারা ছিলেন তের জন। তা ছাড়া সম্রাট আকবরের সময়ে বার ভূঁইয়া ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বার ভূঁইয়া হুবহু একই ব্যক্তিবর্গ ছিলেন না। 

কয়েকজন উল্লেখযোগ্য বার ভূঁইয়াঃ ঈসা খান, মুসা খান, রাজা প্রতাপাদিত্য, চাঁদ রায়, কেদার রায়, ফতেহ খান প্রমুখ। 

উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ বার ভূঁইয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। মুসা খানের পরাজয়ে বার ভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে।

প্রশ্নঃ (ঘ) সুবাদার শায়েস্তা খানের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ শায়েস্তা খানের গৃহীত পদক্ষেপঃ ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলার সুবাদার ছিলেন। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কতকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- 

১. শায়েস্তা খান ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম দখল করেন।
২. শায়েস্তা খানের সুবাদারির শেষদিকে তিনি ইংরেজদেরকে বাংলা সুবা থেকে বিতাড়িত করেন।
৩. শায়েস্তা খান সকল জিনিসপত্রের দাম সস্তা রাখার ব্যবস্থা করেন।
৪. সুবাদার শায়েস্তা খান পার্শ্ববর্তী রাজ্যের আক্রমণ হতে বাংলাকে রক্ষার পদক্ষেপ নেন।
৫. সুবা বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানুষের জানমাল রক্ষা এবং রাজ্যসীমা অক্ষুন্ন রাখতে যোগ্য সেনাপতি নিয়োগ করেন।

প্রশ্নঃ (ঙ) ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে কী জানা যায়?
উত্তরঃ উত্তর আফ্রিকার বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সুলতানি আমলে বাংলা সফর করেন। তাঁর বিবরণ থেকে বাংলার মানুষের পোশাক, অলংকার ও খাদ্য সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য জানা যায়ঃ 

>  ধনী মুসলমান পরিবারে পুরুষের সাধারণ পোশাক ছিল ইজার (পায়জামা) ও লম্বা জামা। জামায় থাকত গলাবন্ধ এবং কোমরে বাঁধা থাকত উজ্জ্বল ফিতা। মাথায় পাগড়ি পরার রেওয়াজ ছিল। পায়ে কারুকাজখচিত চামড়ার জুতা ও মোজা ব্যবহার করা হতো। মধ্যবিত্ত মুসলমান পুরুষেরা পায়জামা, জামা, পাগড়ি ও জুতা ব্যবহার করতেন। সাধারণ মুসলিম পুরুষেরা পরিধান করতেন লুঙ্গি ও ফতুয়া ধরনের জামা। তাঁরা মাথায় টুপি পরতেন। কামিজ, সালোয়ার এবং কখনো কখনো দামি শাড়ি ছিল অভিজাত মুসলিম মহিলাদের পোশাক। তাঁরা দামি ওড়না ব্যবহার করতেন। স্বল্প আয়ের মহিলারা শাড়ি পরতেন। 

> অভিজাত হিন্দু পুরুষ ও রমণীরা জাঁকজমকপূর্ণ ও রুচিসম্মত পোশাক পরতেন। সাধারণ হিন্দুরা ধুতি ও চাদর ব্যবহার করতেন। এক ধরনের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জামাও তাঁরা ব্যবহার করতেন। এ জামার নাম ছিল অঙ্গরাখি। জুতার বদলে তাঁরা পায়ে খড়ম ব্যবহার করতেন। নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা শুধু একপ্রস্থ ধুতি পরতেন। হিন্দু মহিলাদের সাধারণ পোশাক ছিল শাড়ি। পুরুষ-মহিলা সবাই অলংকার পছন্দ করতেন, তবে অলংকার বেশি প্রিয় ছিল মহিলাদের। সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের অলংকার ব্যবহূত হতো। 

> গ্রামের মানুষ সাধারণ পোশাক পরত। জুতা-মোজার ব্যবহার ছিল, তবে সবার মধ্যে নয়। সাধারণ মানুষ পায়ে কাঠের খড়ম পরত। 

> ভাত, মাছ, তরকারি, ডাল ছিল জনপ্রিয় খাবার। উৎসব অনুষ্ঠানে মাংস পরিবেশনের রেওয়াজ ছিল। তা ছাড়া লোকজন দুধ, দই, ছানা, মিষ্টি, পায়েস, ক্ষীর খেতে ভালোবাসত। খাওয়াদাওয়া শেষে পান খাওয়ার চল ছিল।

প্রশ্নঃ (চ) মধ্যযুগে বাংলায় বিনোদনের কি কি ব্যবস্থা ছিল।
উত্তরঃ মধ্যযুগে বাংলার বিনোদনঃ নানা ধরনের সামাজিক উৎসব পালিত হত তখন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় শিশুর জন্মদিন, নামকরণ এবং হাতেখড়ি অনুষ্ঠান পালন করত। মুসলমান সমাজে শিশুর আকিকা অনুষ্ঠান জাঁকজমকের সাথে পালিত হত। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় ধুমধামের মধ্য দিয়ে বিবাহ উৎসব উদযাপন করত। নানা ধরনের খেলাধুলা সে সময় প্রচলিত ছিল। যেমন চৌগান খেলা, পাশা খেলা, তাস খেলা ইত্যাদি। বাজিকরদের খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিল। এছাড়া পায়রা ওড়ানো, সাঁতার কাটা, নৌকা বাইচ ইত্যাদি ছিল তখনকার জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম। পালাগান, যাত্রা অভিনয় খুব জনপ্রিয় ছিল। মধ্যযুগে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে আলাদা আলাদা ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানকে বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে মনে করা হত।

প্রশ্নঃ (ছ) মধ্যযুগে বাংলায় কী কী সামগ্রী আমদানি ও রপ্তানি হত?
উত্তরঃ মধ্যযুগে বাংলায় ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আমদানির চেয়ে বাংলা থেকে রপ্তানি বেশি হয়েছে। বাংলার বণিকেরা তখন সাগর পাড়ি দিয়ে নানা দেশে বাণিজ্য করত।
আমদানি সামগ্রীঃ মধ্যযুগে বাংলায় বণিকরা এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল এবং ইউরোপ থেকে কিছু পণ্যসামগ্রী আমদানি করতেন। এসব পণ্যসামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্বর্ণ-রৌপ্য, রেশম, বিভিন্ন বিলাসসামগ্রী, চীনা মাটির বাসন-কোসন, মূল্যবান পাথর ইত্যাদি। 

রফতানি সামগ্রীঃ চাল, চিনি, আদা, রসুন, হলুদ, মসলিন ও অন্যান্য ধরনের কাপড় মধ্যযুগে বাংলার রফতানি দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম ছিল। 

পরিশেষে বলা যায়, মধ্যযুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে এদেশীয় দ্রব্যের বেশ কদর ছিল। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।

প্রশ্নঃ (জ) মধ্যযুগে বাংলার ধর্মীয় অবস্থা কিরূপ ছিল?
উত্তরঃ মধ্যযুগে বাংলার ধর্মীয় অবস্থা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। মুসলমান সুফিসাধক ও শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বৈষ্ণব আন্দোলন বাংলায় এক উদার ধর্মীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। সমাজে সকল ধর্মের মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা ছিল। 

মধ্যযুগে বাংলার ধর্মীয় অবস্থাঃ ধর্মীয় সূচনা হয় তের শতকের শুরুর দিকে মুসলিম শাসনামলে। ধীরে ধীরে মুসলমান সুফীসাধক ও শাসকগণ বাংলার এক উদার ধর্মীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। সমাজে সকল ধর্মের মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা ছিল। এ সময় নানান ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় ছিল। প্রত্যেকে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করত। এ সময় অনেক হিন্দু উচ্চ রাজপদে কাজ করতেন। মুসলমান সমাজে প্রধান ধর্মীয় উৎসব ছিল ঈদুল ফিরত ও ঈদুল আযহা। এ ছাড়া হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মবার্ষিকী ঈদে মিলাদুন্নবী ও লাইলাতুল বরাত পালিত হত। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায় নানান ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতেন। মধ্যযুগে ধর্মীয় অবস্থার এরূপ পরিস্থিতি ছিল এক যুগান্তকারী দিক। মানুষের মধ্যে ছিল সম্প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক যা মোগল আমল পর্যন্ত একইভাবে অব্যাহত থাকে। 

পরিশেষে বলা যায়, মধ্যযুগে বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে আড়ম্বরের সাথে পালন করত।

No comments:

Post a Comment

Clicky