২৫ মে শনিবার- সাল ২০১৯, ৬৫ বছর বয়সী আনোয়ারা বেগম ঢাকা থেকে জামালপুর যাচ্ছিলেন আন্তনগর ট্রেন অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসে করে । ছেলে, মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে ট্রেনে করে বাড়ি যাচ্ছিলেন ঈদ করতে । জামালপুরের মেলান্দহে আনোয়ারা বেগম এর বাড়ি । বেলা দেড়টার দিকে ময়মনসিংহ স্টেশনে ঢুকতে আর কয়েক মিনিট বাকি, ট্রেনের গতি কিছুটা কমে এসেছে, এমন সময়ই হঠাৎই ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে থেকে একটি ঢিল এসে লাগল আনোয়ারা বেগমের বাঁ চোখের পাশে। মূহূর্তেই চোখ ধরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে অনেক রক্ত ঝরতে থাকে। পরিবারের অন্য সদস্যরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না, হঠাৎ ঘটনাটা কী ঘটল। মুহূর্তেই পরিবারটির ঈদের খুশি মাটি হয়ে গেল । ঘটনার পর পর ট্রেনের কর্মীরা দ্রুত এগিয়ে এসে পানি দেন।
আনোয়ারা বেগমের পরিবারের সদস্যরা মায়ের চোখ ধরে জামালপুর পর্যন্ত পৌঁছে পরে চিকিৎসকের কাছে যান। ঘটনার সময় আনোয়ারা বেগমের স্বামী আবদুল হাই, ছেলে মনোয়ার হোসেনসহ পরিবারের অনেক সদস্য ছিলেন। ফলে ময়মনসিংহে নামার কোনো উপায় ছিল না বলে জানালেন আনোয়ারা বেগমের ছেলে মনোয়ার হোসেন। আনোয়ারা বেগমের দুই ছেলে ১) পোশাক কারখানার কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন ২) ব্যাংকার আবদুল কাদের জিলানী।
হঠাৎ ঘটনাটি ঘটায় পুরো পরিবার হতবিহ্বল হয়ে পড়ে । আনোয়ারা বেগমের ছেলে আবদুল কাদের জিলানী জানান, ‘ঢাকার রামপুরায় আমার বাসা থেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে ঈদ করার জন্য বাড়ি যাচ্ছিলাম। পরিবারের আমরা সবাই ছিলাম বেশ আনন্দময় মেজাজে। কিন্তু হঠাৎই কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল ভাবতেই পারছি না । জামালপুরের চিকিৎসক তো প্রথমে ভেবে নিয়েছিলেন মা হয়ত আর চোখে দেখতে পারবেন না। পরবর্তীতে তিনি ঢাকার ফার্মগেটে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন । আমরা আর দেরি করলাম না, দ্রুত মাকে ঢাকা নিয়ে এসে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি করালাম । এর পর চিকিৎসকের কথামত সোমবার মায়ের চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে । চিকিৎসকেরা জানালেন , মায়ের চোখের লেন্স পাল্টাতে হবে, তবে আশা করা যায় মা হয়তো আবার আগের মত পুরোপুরি চোখে দেখতে পারবেন ।
ছেলে ’মনোয়ার হোসেন আক্ষেপের সহিত বলেন, ‘আম্মাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি, সেই আম্মাকে দেখি চোখ ধরে ধরে কাঁদছেন। আম্মার চোখের ঢিল তা আবার আম্মার পাশে বসা আরেক নারীর গায়েও লাগে । ঘটনার পর মাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জামালপুর রেলওয়ে থানায় মৌখিকভাবে ঘটনার কথা জানানো হয়েছে । বৃহস্পতিবর প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে ছেলে আবদুল কাদের জিলানী কয়েকবার উল্লেখ্য করে বললেন ‘মায়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু এই বয়সেও মা চোখে খুব ভালো ভাবেই দেখতে পেতেন । শরীরে কোনো রোগও নেই। সেই মা এখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। ঈদে বাড়ি যেতে না পারলে মন খারাপ করবেন । তাই সমস্যা হলেও সবাই মিলে বাড়ি গিয়ে ঈদ করব বলে মনস্থির করেছি।’
এ ঘটনার পেক্ষিতে কয়েকজন জানান----
১. এই ঘটনার সূত্র ধরে টেলিফোনে কথা হয় ময়মনসিংহের আশরাফুর রহমান নামে এক ব্যক্তির সাথে । ময়মনসিংহ রেল কলোনির কাছেই তাঁর বাসা। তিনি জানালেন বুধবারের একটি ঘটনার বিষয়ে, বুধবারের একটি ট্রেন যাওয়ার সময় তিনি খেয়াল করছিলেন, এক লোক তার হাতে একটি পাথর। তবে আমি সেই লোকের দিকে খেয়াল রাখার কারণে পাথর হাত থেকে ফেলে দেন। ট্রেন চলে যাওয়ার পর যখন পাথর হাতে রাখার কারণ জানতে চাইলাম, তখন উল্টো সেই লোক বলছেন, পাথর হাতে নিলে সমস্যা কী? তারপর এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হলে আশেপাশের লোকজন এসে মীমাংসা করে দেন।
২. জামালপুরের শেরপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাসুমা হোসনি বললেন, ময়মনসিংহ স্টেশনের কাছাকাছি গেলে ট্রেন যখন একটু আস্তে চলে, তখনই এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে । নিজের পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মাসুমা জানান, প্রায় সাত থেকে আট বছর আগে ট্রেনে যাওয়ার সময় তিন মাস বয়সী ভাইয়ের ছেলের চোখ অল্পের জন্য রক্ষা পায়। ওই ঘটনার পর ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে ভাইয়ের ছেলেকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয় এবং প্রায় কাছাকাছি বসে থাকা আরেক মামার মাথায় পাথর লেগে মাথা ফেটে যায় ।
সেক্ষেত্রে মাসুমা হোসনি বললেন, স্টেশনের কাছাকাছি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ঘটনা ঘটছে, তার মানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ঘটনাগুলো সম্পর্কে অজানা নয় । কিন্তু এর কোনো প্রতিকার আজও হচ্ছে না। ঢাকা-জামালপুর যাতায়াতে বেশির ভাগ সময় ট্রেনে যাতায়াত করেন তিনি । মাসুমা আরও বলেন, ‘এখন স্টেশনের কাছাকাছি এলেই জানালা নামিয়ে দিই। আর মনের মধ্যে ভয় কাজ করতে থাকে। একটি পাথর থেকে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তা যদি যারা ঢিল ছুড়ছে তারা জানত।’
২. জামালপুরের শেরপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মাসুমা হোসনি বললেন, ময়মনসিংহ স্টেশনের কাছাকাছি গেলে ট্রেন যখন একটু আস্তে চলে, তখনই এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে । নিজের পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মাসুমা জানান, প্রায় সাত থেকে আট বছর আগে ট্রেনে যাওয়ার সময় তিন মাস বয়সী ভাইয়ের ছেলের চোখ অল্পের জন্য রক্ষা পায়। ওই ঘটনার পর ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে ভাইয়ের ছেলেকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয় এবং প্রায় কাছাকাছি বসে থাকা আরেক মামার মাথায় পাথর লেগে মাথা ফেটে যায় ।
সেক্ষেত্রে মাসুমা হোসনি বললেন, স্টেশনের কাছাকাছি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ঘটনা ঘটছে, তার মানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ঘটনাগুলো সম্পর্কে অজানা নয় । কিন্তু এর কোনো প্রতিকার আজও হচ্ছে না। ঢাকা-জামালপুর যাতায়াতে বেশির ভাগ সময় ট্রেনে যাতায়াত করেন তিনি । মাসুমা আরও বলেন, ‘এখন স্টেশনের কাছাকাছি এলেই জানালা নামিয়ে দিই। আর মনের মধ্যে ভয় কাজ করতে থাকে। একটি পাথর থেকে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তা যদি যারা ঢিল ছুড়ছে তারা জানত।’
৩. প্রীতি দাশ, চার ভাইয়ের সংসারে প্রীতি দাশ একমাত্র বোন। খুব জাঁকজমক করে ঘটনার মাত্র ১৭ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল প্রীতি দাশের। তিনি বাবার বাড়িতে গেছেন ঈদের ছুটিতে। চট্টগ্রামে, পশ্চিম পটিয়ার গ্রামে। ঈদ করে ঈদের পরদিন, ১০ আগস্ট ২০১৩ রাতের ট্রেন ফিরছিলেন ঢাকায় । ট্রেন সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী ভাঙা ব্রিজ এলাকায় গেছে মাত্র। এর একটু আগে প্রীতি মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন মা-বাবার সঙ্গে, তাঁদের জানিয়েছেন, ট্রেন ছেড়েছে, যাচ্ছি। মা বলেছেন, ভালো ভাবে যাস। সঙ্গে স্বামী আর স্বামীর বন্ধু। ট্রেনের জানালার কাচও নামানো। কোনো ধরণের বিপদ হওয়ার কথা নয়। তবে জানালার কাচ ভেঙে পাথর এসে লেগেছিল প্রীতির মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারান। সীতাকুণ্ড হাসপাতাল, তারপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন প্রীতিকে।
২০১৩ সালে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক প্রথম আলোতে লিখেছিলেন ‘প্রীতির জন্য ভালোবাসা’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ। প্রীতি দাশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মিন্টু দাশ ঢাকার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রধান শাখার কর্মকর্তা ছিলেন।
আনিসুল হক লিখেছিলেন, ‘প্রীতির মৃত্যু কি থামাতে পারবে ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ছেলেখেলা!’ ২৭ মে ‘চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়বেন না’ শিরোনামে প্রথম আলোতেই আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আসন্ন ঈদুল ফিতরের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ট্রেনে চড়ে বাড়ি যাবেন হাজারো যাত্রী। তবে এই আনন্দ বিষাদে পরিণত হতে পারে চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়ে মারার মতো এমন ঘটনায়। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না করার জন্য সীতাকুণ্ড থানা-পুলিশ সীতাকুণ্ডে চারটি রেলস্টেশন ও আশপাশের এলাকার লোকদের সচেতন করতে ‘চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়বেন না’ বলে প্রচারণা চালিয়েছে। প্রায় প্রতি ঈদের আগেই এভাবে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়, গণমাধ্যমে তা প্রচারিত এবং প্রকাশিত হয়।
ময়মনসিংহ রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোশাররফ হোসেন জানালেন, গত বছরের মে মাসে ট্রেনে ঢিল ছোড়ার একটি মামলার আসামি ধরা পড়েছে। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে এমন ঘটনায় বেশির ভাগই অভিযোগ করেন না। মোশাররফ হোসেন বলেন, ট্রেনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিশোরেরা ঢিল মারে । সেক্ষে রেলওয়ে আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের অপরাধে বাবা-মাকে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। ট্রেনে ঢিল বা পাথর ছোড়া ঠেকাতে রেলওয়ের পক্ষ থেকে
সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। ঢিল বা পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে রেলওয়ে আইনের ২৭ ধারায় মামলা করার সুযোগ আছে বলে জানান মোশাররফ হোসেন।
আবদুল কাদের জিলানী তাঁর মায়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘একটি ঢিল অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। অথচ ঢিল মারা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, একই সঙ্গে এলাকার মানুষকে নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা।
ট্রেনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো যায় কি না, তাও চিন্তাভাবনা করে দেখতে পারে কর্তৃপক্ষ। আমরা যাত্রীরা তো অসহায়। ওই অবস্থায় নেমে কোনো ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হয় না।’
আমাদের এই পোষ্টটি ভালো লাগলে অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজ এ লাইক বাটন ক্লিক করে পরবর্তী নিউজের সাথে আপডেট থাকবেন। বন্ধুদের সাথে পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না।
Image Source www.google.com
No comments:
Post a Comment